মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক অবরোধের আহ্বান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানকে সাহায্য ও ত্রাণসামগ্রী দেওয়া সম্পর্কে ২৬ এপ্রিল প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়। কমন্স সভার সদস্যরা সে বিতর্কে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রীকে নানা প্রশ্ন করেন।
কমন্স সভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময়ে যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড বলেন, পাকিস্তানকে যেসব দেশ সহায়তা করে থাকে, তাদের সঙ্গে সাহায্য দেওয়ার শর্ত নিয়ে আলোচনা করা হবে। জুলাই মাসের আগেই এ বৈঠক হবে। একজন এমপির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির ওপর সেখানে আরও সাহায্য দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রচেষ্টায় যোগ দিতে বলা হলে যুক্তরাজ্য সানন্দে তাতে রাজি হবে।
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাস–মান কলকাতা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবরোধও স্থাপন করা দরকার। ডগলাস–মান ভারত সীমান্ত থেকে দুই মাইল ভেতরে গিয়ে দুই ঘ ণ্টা ঘুরে বাংলাদেশের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আসেন।
নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ট্রেভর জে ইয়াং কলকাতা প্রেসক্লাবে আরেক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ওপর বিশ্বের সব জাতির পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করা এখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আগের দিন ট্রেভর ইয়াং ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
পাকিস্তান ঢাকার ভারতীয় মিশনের কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সন্দেহজনক আচরণ শুরু করলে ভারত এই দিন একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানকে জানায়, অনুমতি ছাড়া কোনো পাকিস্তানি ভারত ত্যাগ করতে পারবে না। এ আদেশ দিল্লি ও মুম্বাইয়ের পাকিস্তানি মিশনের কর্মচারী, তাঁদের পরিবার ও গৃহকর্মীদের ওপর প্রযোজ্য হবে।
কলকাতার পাকিস্তানি উপহাইকমিশনার হোসেন আলী পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণার পর পাকিস্তান মেহেদি মাসুদকে নতুন উপহাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ২৫ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে কলকাতায় বিক্ষোভ হয়।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চার শ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন ভারতের রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাড়িয়া। ভারতের রাজ্যসভার বিরোধী দলের নেতা এম এস গুরুপদস্বামী পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন সংগ্রহ এবং ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ইতিহাস সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দেওয়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২৯ এপ্রিল থেকে একটি প্রদর্শনীর ঘোষণা দেন।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ খান মস্কোয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সঙ্গে মস্কোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জামশেদ মারকারও ছিলেন। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি এবং প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ইয়াহিয়ার কাছে পরপর দুটো চিঠি পাঠানোর পটভূমিতে আরশাদ খান সেখানে যান।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খান পূর্ব পাকিস্তানে পরবর্তী ব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য ঢাকায় আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এক আদেশে জানায়, কেউ যোগাযোগব্যবস্থা, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কোথাও ক্ষতি করা হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সবার বিরুদ্ধে গণহারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন আরও জানায়, সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলজুড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
শালগড়ে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবদুল ওহাবের (পরে বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালগড়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল এই দিনে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করে। পাকিস্তান বাহিনীর তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওহাব তাঁর কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম এইচ এ আবদুল গাফফারের (পরে বীর উত্তম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) সম্মতি নিয়ে আগের দিন ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এলাকায় যান। ২৬ এপ্রিল দুপুরে কৃষকের ছদ্মবেশে অ্যামবুশের জায়গা রেকি করেন। রাতে শালগড়ে অ্যামবুশ করেন। রাত ১২টার দিকে একটি পাকিস্তানি কনভয়ের প্রথম দিককার ৮-১০টি জিপ, পিকআপ ও ট্রাক এসে পৌঁছায়। গাড়িগুলো এলাকার ভেতরে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে হামলা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের খবরে জানা যায়, এ অভিযানে পাকিস্তানিদের দুটো গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং প্রায় ১৮টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ জনের মতো হতাহত হয়।
‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’
টাইম ম্যাগাজিন–এর এই দিনের সংখ্যায় ‘পাকিস্তান: সীমান্তের দিকে চাপ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। তাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ শহর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অধিকাংশ গ্রামের দখল এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানকে কবজা করে রাখার সংকল্পে পাকিস্তান যতই অটল থাকুক, পরিস্থিতিদৃষ্টে সিদ্ধান্তে আসতে হয়, ‘শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
আরেক প্রখ্যাত ম্যাগাজিন নিউজউইকও গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে একাধিক খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এবং সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ইতিহাস কিছু ভোলে না’ শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৭ এপ্রিল ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ এপ্রিল ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
জামিনে ছাড়া পেয়েই অপরাধে জড়িত, কিশোরকে অপহরণ
-
কিরগিজস্তানে বিদেশিদের ওপর হামলা, আতঙ্কে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
-
পাবনায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, মামলা
-
স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফিৎসোর অবস্থা এখনো গুরুতর
-
ধোনি-ঝড়ের পরও চেন্নাইয়ের বিদায়, শেষ চারে কোহলির বেঙ্গালুরু