মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
পাকিস্তানের পক্ষে চীনের অবস্থান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি ৭ নভেম্বর দেশটিতে সফররত পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সম্মানে বেইজিংয়ে আয়োজিত এক সরকারি ভোজসভায় বাংলাদেশ সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, সংহতি ও অখণ্ডতার কথা মনে রেখে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পাকিস্তান নিজেই এই ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই উপস্থিত ছিলেন।
রেডিও পাকিস্তান পরিবেশিত খবরে ওই ভোজসভায় চি পেং ফির বক্তৃতার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, বিদেশ থেকে আক্রমণ হলে পাকিস্তানকে চীন সমর্থন করবে।
চীন সফররত পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীন-পাকিস্তান আলোচনার কারণে এশিয়ায় আক্রমণের আশঙ্কা দমিত হবে। ভারতের হুমকি এমন গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করা পাকিস্তানের জন্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ইন্দিরার জনসংযোগ
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের দেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে এই দিন প্যারিসে পৌঁছান। প্যারিস সফরকালে তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু, প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাস এবং ফরাসি ভাবুক ও সাবেক মন্ত্রী অঁদ্রে মালরোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ভারত সফররত সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের নেতা ভি কুভারিয়াভয়েত দিল্লিতে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলির দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে।
যুক্তরাজ্যে বৃহত্তর লন্ডন এলাকার বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত ১৪টি অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হয়ে গ্রেটার লন্ডন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন। ৩০ জন প্রতিনিধি ও দর্শক সভায় যোগ দেন। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচির সমন্বয় এবং প্রস্তাবিত জাতীয় সম্মেলন সফল করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার মুরাদনগরের চাপিতলায় ৭ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই দিনব্যাপী যুদ্ধ চলে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা চাপিতলায় প্রতিরক্ষা তৈরি করে সেখানে অবস্থান নিতে থাকেন। খবর পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের সেনা সমন্বয়ে গড়া একটি বড় দল মুক্তিযোদ্ধাদের চাপিতলা অবস্থানের দুর্বল দিকে আক্রমণ করে। এই অবস্থায় পাকিস্তানিদের বিভ্রান্ত করার জন্য পি–৮০ গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূম্রকুণ্ডলী সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান থেকে পিছু হটে যান। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। রাতে তারা আবার মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা ততক্ষণে বেশ সংগঠিত। পরদিন দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এই যুদ্ধে দুজন জুনিয়র কর্মকর্তাসহ পাকিস্তানিদের অনেক সেনা হতাহত হয়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরের বিলোনিয়া অঞ্চলে এদিন সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। রাতে তা আরও তীব্র হয়। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে দুবার বিমান হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকায় তারা মিডিয়াম মেশিনগান দিয়ে স্যাবরকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। পাকিস্তানি একটি বিমানে গুলি লেগে সেটি কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় ভূপাতিত হয়। ওই রাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীও জবাব দিতে থাকে। পরে দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে তারা পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে প্রায় ১৫ জনকে হতাহত করে। দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এ ছাড়া কাইমপুর এলাকাতেও দুই পক্ষের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল এই দিন নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে। এই লক্ষ্যে তারা নদীর ওপারে বন্দর থানার নবীগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এই গেরিলা যোদ্ধাদের আরও দুটি দলের একটির অভিযানে নারায়ণগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য সুলতান উদ্দিন খান এবং শান্তি কমিটির সদস্য আমীর হোসেন নিহত হন। অন্য দলের অভিযানে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হাজি সাহেব আলী নিহত হন।
নরসিংদীর গেরিলারা শিবপুর থানায় পাকিস্তানপন্থীদের ওপর হামলা করলে একজন আহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহীর শাহপুর সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে আক্রমণ করলে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হলে বাকিরা মহানন্দা নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার ধোপাখালীতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৮ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৮ ও ৯ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য ৮ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে