মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ভাসানীকে নিয়ে কথা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনাধারা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভায় ১৫ মে ভাসানী ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে আলোচনা হয়। সিপিআইএমের সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার বিধানসভায় আগের দিন অভিযোগ করেছিলেন, ভাসানীকে কলকাতার কোথাও অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। তার জবাবে সরকারি দলের নেতা এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, মাওলানা ভাসানী কোথায় আছেন, তিনি তা জানেন না।
মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পর হরেকৃষ্ণ কোঙার বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী ভারতবর্ষের কোথাও মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেছেন। হঠাৎ তাঁকে না পাওয়া গেলে মানুষের এ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে এখানে কোথাও তাঁকে রাখা হয়েছে।
হরেকৃষ্ণ কোঙার পরে অনাস্থা প্রস্তাবের আলোচনায় আবার ভাসানীর প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভাসানী সাহেবের মতো বিশিষ্ট নেতা কোথায় আছেন, সরকার তা জানে না। তাহলে তিনি কি অন্তর্ধান হলেন? এ ঘটনা কি বাংলাদেশের লড়াইয়ে সহায়ক হবে?
হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আলাদা তিনটি অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা অব্যাহত থাকলে গোটা উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতি ব্যাহত হবে।
একটি অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে তারা যেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে না করে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার যাঁরা হচ্ছেন, তাঁরাও মুসলমান।
অন্য দুই অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য ডা. সারওয়ার আলী ও মাহবুব আলী বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তর মুজিবনগর থেকে এক জানায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির জনসংযোগ অফিস চালু করা হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ে এবং ত্রাণ তহবিলে সাহায্য দিতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এখন থেকে এই অফিসে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়।
কলকাতায় বাংলাদেশের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ফুটবল খেলোয়াড় আলী ইমাম জানান, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা প্রথম ডিভিশনের ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি ফুটবল দল গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই দল পশ্চিমবঙ্গের নামী ফুটবল দলের বিরুদ্ধে প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেবে। তাতে যে অর্থ সংগৃহীত হবে, তা মুক্তিযুদ্ধে ব্যয় করা হবে।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামের শিলচরে ও ত্রিপুরার আগরতলায় শরণার্থীদের স্বচক্ষে দেখে এসে আগরতলায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার এখন হয়ে উঠেছে ভারতের একটি সমস্যা। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সমস্যা বিশেষ কোনো রাজ্যের ব্যাপার নয়; কেন্দ্রই এর পূর্ণ দায়িত্ব নেবে।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) কলকাতা জেলার উদ্যোগে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ারে আয়োজিত এক জনসভায় বাংলাদেশ এবং এর সরকারকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সব রকম সাহায্যের দাবি জানানো হয়।
পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখার পরামর্শ ব্রিটেনে
পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখার জন্য ব্রিটিশ কমন্স সভায় এদিন বিরোধী দলের সদস্যরা উপর্যুপরি দাবি জানান। বেসরকারি একটি প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কমন্স সভায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ নিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে আলোচনা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান। প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলের সদস্যদের সঙ্গে সরকারি দলের অধিকাংশ সদস্যও পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে উদ্বেগ জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম আলোচনায় অংশ নিয়ে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। ব্রিটেন পাকিস্তানের জনগণের বর্তমান সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক সমাধান চায়। আর বাইরে থেকে কেউ সেটা চাপিয়ে দিতে পারে না।
প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর ব্যবধান ছিল। বিরোধী লেবার পার্টির সদস্যরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও সরকারপক্ষের সদস্যরা বিপক্ষে ভোট দেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া দরকার বলে সরকারি দলের সদস্যরা স্বীকার করেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিন ঢাকায় বলেন, প্রদেশের সব জায়গা থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ নির্মূল করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সন্ত্রাস চলছে, তা বিচ্ছিন্ন।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য খুলনার আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জনকে নিয়ে আনসারের বিকল্প একটি বাহিনী গঠন করেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের তিনজন এমপিএ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তাঁরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
হবিগঞ্জের ভবানীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের পাতা মাইনে এবং তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে নালুয়া চা-বাগান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি পাকিস্তানি সেনাদলকে অ্যামবুশ করেন। এতে সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকজন হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর তিন; পূর্বদেশ, ১৬ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৬ মে ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
ডিজিএফআইয়ের চেয়েও ভয়ংকর ছিল র্যাবের গোপন বন্দিশালা
-
নির্বাচিত সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার: মির্জা ফখরুল
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে রাশিয়া, অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দাদের
-
‘ভূতের মুখে রামনাম’: হাছান মাহমুদের বক্তব্য নিয়ে মির্জা ফখরুল