মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
তাহের-মঞ্জুর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারজন বাঙালি কর্মকর্তা সীমান্ত অতিক্রম করে ২৬ জুলাই ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁরা হলেন মেজর আবু তাহের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও কর্নেল), মেজর এম এ মঞ্জুর (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও কর্নেল) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারি (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাঁদের মধ্যে মেজর মঞ্জুর আসেন সপরিবার।
উ থান্টের চিঠির মিশ্র প্রতিক্রিয়া
ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। গত সপ্তাহে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে যে গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তার পরই এই বৈঠক হলো। উ থান্ট ওই বার্তায় বাংলাদেশ সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্ভাব্য সংঘর্ষের আশঙ্কা জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলোর কাছে এ ব্যাপারে অভিমত জানতে চেয়েছেন। এ সংঘর্ষ এড়াতে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কর্তব্যের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি পত্রটির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের এবং ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধির কাছে পাঠিয়ে দেন।
ভারতের সংসদে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং উ থান্টের এই চিঠির কথা বলেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা কে কী মনে করছেন, তা জানার জন্য ভারত সরকার সক্রিয় রয়েছে বলে জানানো হয়। উ থান্টের প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে সমান কাতারে রাখায় নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলের নেতাদের বলেন, সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নীতি স্থির করেনি। জাতীয় এবং বাংলাদেশের স্বার্থে যখনই প্রয়োজন হবে, তখনই এই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন সাংবাদিকদের বলেন, উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো বার্তা সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছেন। সমর সেন মহাসচিবকে তা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো সম্পর্কে সমর সেন বলেন, মহাসচিবকে তিনি বলেছেন যে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৪০ হাজার করে শরণার্থী ভারতে আসছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা কী করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।
পাকিস্তানি দূত আগা শাহি উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের কাছে লিখিত পত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিস্তৃতভাবে তিনি জানতে চেয়েছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা শান্তির জন্য বিপজ্জনক। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।
বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তে এবং যুক্তরাজ্যের সংসদ কমন্সসভায় লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউসের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চেষ্টায় ২৬ জুলাই লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট উন্মোচন করা হয়। কমন্স সভার হারকোর্ট রুমে সাংবাদিকদের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট উন্মোচন করেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
কলকাতার বাংলাদেশ মিশনেও এক অনুষ্ঠানে নতুন ডাকটিকিট দেখিয়ে সাংবাদিকদের জানানো হয় যে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। জানানো হয়, ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ডাকটিকিট জনসাধারণের কাছে বিক্রির জন্য বাংলাদেশ মিশনে একটি কাউন্টার খোলা হবে। মিশন প্রধান এম হোসেন আলী জানান, বাংলাদেশের এবং বাইরের ডাক চলাচলে ডাক যোগাযোগে এখন থেকে নতুন এই ডাকটিকিট ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশ সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নানা রঙে মোট আট রকমের টিকিটের নকশা আঁকেন বাঙালি গ্রাফিক ডিজাইনার বিমান মল্লিক।
আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে বাংলাদেশের সব বামপন্থী দল নিয়ে ন্যাপ (ভাসানী) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করছেন বলে কয়েক দিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, ২৬ জুলাই একটি বিবৃতি দিয়ে ভাসানী তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বাম, ডান বা মধ্যপন্থী, সবার একমাত্র লক্ষ্য এখন স্বাধীনতা। কিছু লোক ব্যক্তিস্বার্থে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বাম শক্তিসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ নীতিতে যুক্তরাজ্য অটল
পাকিস্তানি হাইকমিশনারের অনুরোধে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম এদিন পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁদের উন্নয়ন সাহায্য পেতে হলে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁদের নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
জেনেভার কূটনৈতিক মহলের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শরণার্থী গ্রহণ কেন্দ্রে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নিয়েছে। পর্যবেক্ষক দলের কাজ হবে বেশি সংখ্যায় শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার দিকে নজর রাখা এবং তাদের উৎসাহ দেওয়া।
এক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানের কাছে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাব দিলে পাকিস্তান তা বিনা শর্তে মেনে নেয়। তবে ভারত তার মনোভাব জানায়নি।
সূত্র: ইত্তেফাক, ২৭ জুলাই ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৭ ও ২৮ জুলাই ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে