মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
ঢাকায় দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
১৮ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে ঢাকায় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাম্প্রতিক একটি দুঃসাহসিক অভিযানের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ঢাকা তখন পাকিস্তানি সেনাদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাজালে বেষ্টিত। অভিযানটি এর মধ্যেই সফলভাবে সম্পন্ন হয়। খবরে বলা হয়, ১৭ জুন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের একটি দল খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। একজন মার্কিন ও দুজন ব্রিটিশের এই দল যখন ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে তাদের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় আকস্মিকভাবে তিনটি বোমা গাড়ির কাছে বিস্ফোরিত হয়। একটি বোমা গাড়ির কাছেই বিস্ফোরিত হওয়ায় ওই সদস্যরা সামান্য আঘাত পান।
প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র একটি দল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই গেরিলা অভিযান চালিয়েছিল আরও আগে। নিউইয়র্ক টাইমস ঘটনাটি ১০ জুন ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে পরবর্তী সময়ে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের স্মৃতিচারণায় বলেছেন, এই অভিযান তাঁরা চালিয়েছিলেন ৯ জুন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল সে সময় ঢাকায় ছিলেন। অভিযানের সময়টিতে তাঁরা হোটেলে ফিরেছিলেন। রাজধানীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করে এমন অভিযান সামরিক প্রশাসনকে হতভম্ব করে দেয়।
সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক), হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম), কামরুল হক স্বপন (বীর বিক্রম)। তাঁরা যে গাড়িতে করে এসে অভিযানে অংশ নেন, সেটি চালিয়েছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর শ্যালক এফডিসির আলোকচিত্রগ্রাহক মুনির আলম মির্জা।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল রাতে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াত বিঘ্নিত করার জন্য কুমিল্লা-লাকসাম রেলপথের বিজয়পুর রেলসেতু ও কুমিল্লা-বাগমারা সড়কের একটি সেতু উড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি বিজয়পুর ও মিয়াবাজারের কাছে ইলেকট্রিক টাওয়ার উড়িয়ে দিয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দুটো দল কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে সায়দাবাদে এবং মিয়াবাজারের দক্ষিণে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আরেকটি দল খিলা রেলস্টেশনের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপকে অ্যামবুশ করে।
‘জনযুদ্ধে জনতার জয় সুনিশ্চিত’
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান প্রায় ২৫ দিন ধরে মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ১৮ জুন মুজিবনগরে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, তিন-চার মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনী তৈরি হবে।
কিসের ভিত্তিতে তিনি এ কথা বলছেন, সে প্রশ্নের জবাবে কামারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে, তা জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে সংঘবদ্ধ জনতার জয় সুনিশ্চিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তিন মাস ধরে বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশে অসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় সরকারি চারুশিল্প কলেজের গ্রন্থাগারে দুই বাংলার শিল্পীদের সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী কামরুল হাসান। সমাবেশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আগামী আগস্টে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবে। সেখানে ছবি বিক্রির সব টাকা মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যয় করা হবে।
সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী চিন্তামনি কর ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা চিত্রশিল্পীদের ছবি আঁকার জন্য তিনি বিনা মূল্যে রং, তুলি ও ক্যানভাস দেবেন। এ ছাড়া দুজন শিল্পীকে এবং সোসাইটি অব কনটেম্পরারির একজন শিল্পীকে স্টুডিওতে কাজ করতে দেবেন।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান দিল্লিতে ভারতের শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ত্রাণের দিকটি দেখবে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে মাথা ঘামাবে না।
পাকিস্তানের আর্থিক কর্মসূচিগুলো বিবেচনার ব্যাপারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক। ভারত এতে সন্তোষ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ ঘটনাকে ভারত তাদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচারের সাফল্য হিসেবে দেখে।
নিক্সনকে কেনেডির অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দেখা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা যে এখন সারা বিশ্বের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেওয়ার আগে তিনি এ সাক্ষাতে মিলিত হন।
এডওয়ার্ড কেনেডি প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি নিযে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যে নীরবতা অবলম্বন করা হচ্ছে, তাতে মানুষের মর্মান্তিক বিপর্যয়কে চাপা দেওয়া হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ত্রাণকার্যে ও যুদ্ধজর্জরিত পাকিস্তানে শান্তি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ও প্রতিরক্ষা উৎপাদনমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা বার্নে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিয়েরে গ্লাবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, শরণার্থী সংকটে ওই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক শক্তিগোষ্ঠীকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সফররত ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য জেমস টিন ঢাকা থেকে করাচি ফিরে বলেন, পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করা খুবই ভুল হবে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বিবৃতিতে দেশত্যাগীদের স্বদেশে ফিরে আসার জন্য আবারও আহ্বান জানিয়ে বলেন, সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসন ও পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাঁর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে এই দিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, বিচারপতি নূরুল ইসলাম, পিডিপির সহসভাপতি মাহমুদ আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী দীন মোহাম্মদ সাক্ষাৎ করেন।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম লাহোরে বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের জন্য একটি জাতীয় পরিষদ দরকার। দেশে জাতীয় পরিষদের অবর্তমানে কোনোমতেই বেআইনি ঘোষিত ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।
ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে কৈখোলা দখল করে। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পুনর্গঠিত হয়ে কৈখোলায় পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টা তীব্র যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কৈখোলা আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
একদল পাকিস্তানি সেনা স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে বাগেরহাট সদরের কান্দাপাড়া বাজারে ১৮ জন যুবক, ৩ জন বৃদ্ধ ও ২ জন শিশুকে হত্যা করে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; ইত্তেফাক ও আজাদ, ১৯ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৯ ও ২০ জুন ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম আবারও বিএসইসি চেয়ারম্যান, যেমন ছিল তাঁর আগের ৪ বছর
-
নারী আম্পায়ারের ম্যাচ আসলেই কি খেলতে চাননি মুশফিক–মাহমুদউল্লাহরা
-
রাস্তার ইট তুলে বিক্রি করলেন চেয়ারম্যান
-
ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে যে বদল এসেছে
-
গরমের দাপট আজও থাকবে, মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা