মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

গণহত্যা নিয়ে বিশ্বের উদ্বেগ

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

যুক্তরাজ্যের এমপি জন স্টোনহাউস ২৭ এপ্রিল বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ঢাকায় ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যা করেছে, তা নিঃসন্দেহে গণহত্যা। নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোটার যে রায় দিয়েছেন, সামরিক জান্তা সেই গণতান্ত্রিক রায়কে কেবল প্রত্যাখ্যানই করেননি, তা ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছেন। এ ব্যাপারে সবার কর্তব্য রয়েছে। কারও নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত নয়।

ব্রিটেনের কমন্স সভায় পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম জানান, ১৯৬৭ সালের পর পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন কোনো অস্ত্র চুক্তি হয়নি।

সুইডেনের বিজ্ঞানী, লেখক ও রাজনীতিকেরা স্টকহোমে বৈঠকরত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা জাতিসংঘে উত্থাপনের আবেদন জানান।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ভারত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং তাদের ভূমি দখল করতে চায় না। তবে ভারতের ওপর কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে সমুচিত জবাব দেবে।

ভারতের সমাজবাদী দলের নেতা এস এম যোশী বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্র যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সে জন্য ভারতের অগ্রণী হওয়া উচিত। ভারত এগিয়ে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সাহায্য করলে তার ঐতিহ্য রক্ষা পেত।

কলকাতায় এই দিনেও পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ এড়াতে তিনি কলকাতা ছেড়ে শহরতলিতে পুলিশ বাহিনীর একটি ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেন। বিক্ষোভের ঢেউ সেখানেও গিয়ে পৌঁছায়।

বাংলাদেশের সমর্থনে নেপালে ছাত্ররা মিছিল করে সরকারের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। নেপাল ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের জাতীয় কমিটি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করতে বিবৃতি দেয়।

মহালছড়িতে শহীদ বীর উত্তম আফতাবুল কাদের

খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি রামগড়ে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি মহালছড়িতে যুদ্ধে যান। পাকিস্তানি কমান্ডোরা মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরেও ফেলে। পাকিস্তানি সেনাবেষ্টনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে আফতাবুল কাদের গোলাগুলির মধ্যেই একটি কৌশলগত অবস্থানে ছুটে গিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি শহীদ হন।

প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। তবে তাঁরা আফতাবুল কাদেরের মরদেহ রামগড়ে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর বীর উত্তম উপাধিতে সম্মানিত করে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কূটনীতিকের আনুগত্য

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তারবার্তা পাঠান। এ এইচ মাহমুদ আলীকে পাকিস্তানে বদলি করা হলে তিনি আগের দিন পদত্যাগ করে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। এরপর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

এ ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার জানায়, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করায় তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

পাকিস্তানের তৎপরতা

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এদিন বলেন, কলকাতায় ৫০ জন পূর্ব পাকিস্তানি কূটনীতিক তথাকথিত বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের হাইকমিশন গঠন এবং কলকাতায় দায়িত্ব নেওয়া নতুন উপহাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কারণে ২৬ এপ্রিল থেকে কলকাতার পাকিস্তান মিশন এবং একই সঙ্গে ঢাকার ভারতীয় মিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ঘোষণা দেন, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী (ইপিসিএফ)।

বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ

লন্ডনের ডেইলি মিরর পত্রিকার প্রথম পাতায় উড্রো ওয়াট বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাজ্যের নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে যাঁরা প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা করেন, তাঁরা আজ কোথায়? পরমাণু অস্ত্র বর্জনের জন্য যাঁরা দীর্ঘ মিছিল করেন, তাঁরাই-বা কোথায় লুকিয়ে আছেন? পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা এর চেয়ে অনেক ভয়ংকর।’

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ, কানাডার মন্ট্রিয়ল স্টার, ব্রাজিলের ও প্লোবো এবং মালয়েশিয়ার সারওয়াক ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকাতেও বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক; দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান