মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে ভয়াবহ যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও মেজর) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের (শহীদ, স্বাধীনতার পর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত) নেতৃত্বে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তিবাহিনীর দুটি দল ৩১ জুলাই জামালপুর জেলার কামালপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটিতে (বিওপি) আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দুটি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত। কিছুটা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিটিও ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং আর্টিলারি ও ভারী মর্টারে সজ্জিত।
মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলে পাকিস্তান সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষে কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ৫৯ জন নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৩১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে শহীদ হন। আহত হন ৬৫ জন যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘কামালপুর যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত এবং অসম্ভব আলোচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এটি ছিল প্রথম প্রথাগত আক্রমণ। ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নির্দেশে এবং মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) অধীনস্থ ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানির পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে অংশ নেন।
১১ নম্বর সেক্টরভুক্ত মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল এই দিন লেফটেন্যান্ট এস আই নুরুন্নবী খানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি সেনা–অবস্থানে অতর্কিতে হামলা চালায়। দুই পক্ষের এক ঘণ্টা স্থায়ী তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাবারুদ ভর্তি একটি বার্জ পানিতে ডুবে যায়। বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কসবার একটি ঘাঁটি আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণের চাপে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।
কুমিল্লায় একদল পাকিস্তানি সেনা চৌদ্দগ্রাম থেকে এবং আরেকটি দল জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে নানকারার কাছে এলে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়।
পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ
ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত এই দিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনকে মুহিত বলেন, একটি আত্মহননকারী সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা অসম্ভব ব্যাপার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর দলের কর্মী সমাবেশে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা মোকাবিলায় বিরোধী দলের নেতারা তাঁর হাত শক্ত করতে চান বলে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কয়েকটি দল এখন বাধা সৃষ্টি করছে। অনেকে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, শরণার্থীরা চিরকাল থাকবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো দেশ ভারতকে কিনতে পারবে না। এ ব্যাপারে ভারত কারও নির্দেশও শুনবে না।
বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য ভারতের কংগ্রেস দলীয় সদস্য প্রণব মুখার্জি এদিন রাজ্যসভায় একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন সি চাগলা জোরালো যুক্তি দেখিয়ে ভারত সরকারকে সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। রাজ্যসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং উপস্থিত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি।
বাংলাদেশে গণহত্যায় নেপাল সরকারের ঔদাসীন্যে দুঃখ প্রকাশ করে নেপালের জাতীয় পঞ্চায়েতের কয়েকজন সদস্য বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় উদ্ভাবনে নেপালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে তাঁরা গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আরও নজরদারি
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় জানায়, ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জানমাল রক্ষায় নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সিগুলো দিবারাত্রি গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখবে।
ঢাকার ১ নম্বর সামরিক আইন সাবসেক্টর থেকে সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বার, অভিনেত্রী কবরী, মন্নু ওরফে দলিলউদ্দিন, খসরু ওরফে কামরুল আনাম খান, মন্টু ওরফে মোস্তফা মহসীনসহ ১৯ ব্যক্তিকে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিতে তলব করা হয়। তাঁরা নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হাজির হতে ব্যর্থ হলে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হবে বলে জানানো হয়।
পাকিস্তান সফররত পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তুল মাশায়েখের প্রেসিডেন্ট ও শর্ষিনার পীর এদিন লাহোরে বলেন, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বাইরে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হলে পাকিস্তান তাকে স্বাগত জানাবে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও এগারো; ইত্তেফাক, ১ ও ২ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১ ও ২ আগস্ট ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি: রাজনৈতিক সমঝোতায় সমাধান খুঁজছে সরকার
-
ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় দানা
-
উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না
-
সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে সেটা এই আন্দোলনে থাকা সবার ভুল: আসিফ নজরুল
-
ছেলেদের লিগে মেয়েদের দল: ‘দুঃসাহসী’ রামসবটম ক্রিকেট ক্লাবের গল্প