মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
ওমেগা দলকে ফেরত পাঠাল পাকিস্তান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
বাংলাদেশে ত্রাণকাজে যাওয়া অপারেশন ওমেগা দলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক রাত তাঁদের ক্যাম্পে আটকে রেখে ১৮ আগস্ট ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ২৪ ঘণ্টা সেনা-অবরুদ্ধ থাকার পর তাঁরা ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহে ভারত ফিরে যান। দুটি সাদা গাড়িতে বাংলাদেশের দুর্গত মানুষদের জন্য যেসব ত্রাণসামগ্রী তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন, পাকিস্তান সেনারা সেসব ফেরত দিয়ে দেয়। পাকিস্তানের ভেতরে সেনারা তাঁদের গ্রেপ্তার করে চার মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফেরত
পাঠানোর সময়ও চার মাইল হাঁটিয়ে আনে। রাতে তাঁদের খাবার দেওয়া হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এদিন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশবিষয়ক সব কাজকর্ম সমন্বয় করার জন্য তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দেন।
পাকিস্তানের টুকরো হওয়া রোধ করা যাবে না
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানের রাজনীতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আর এড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের অধিকার একমাত্র মুজিবেরই আছে। তিনি আরও বলেন, জনগণের রায় মেনে নেওয়া হলে এবং মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলে স্বীকার করা হলে এই অভূতপূর্ব রক্তক্ষয় এড়ানো যেত। সাপ্তাহিক নিউ ওয়েভ-এ ১৮ আগস্ট প্রকাশিত সংখ্যায় সম্প্রতি কাবুলে আশ্রয় নেওয়া ওয়ালি খানের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি এদিন মস্কোতে দুই পক্ষ থেকে অনুমোদন করে তা কার্যকর করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে প্রথম সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেতসেভ এবং ভারতের পক্ষে রাষ্ট্রদূত কে এস শেলভাঙ্কর চুত্তিতে স্বাক্ষর করেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরও উদ্বেগ
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন জেনেভায় লিগ অব রেডক্রস এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান।
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ট্র্যায়েগভি ব্রাটেলি বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে ন্যায়সংগত ব্যবহার করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান। নরওয়ের স্থানীয় বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত অ্যাকশন কমিটিও একই দিনে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের বিবরণ-সংবলিত একটি স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাদেশের অধিবাসীদের মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য নরওয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানায়।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সাম্প্রতিক মন্তব্যে ১৮ আগস্ট পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের মতে মহাসচিব তাঁর অধিকারের সীমা ছাড়িয়েছেন। উ থান্ট বলেছিলেন, শেখ মুজিবের বিচারে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহী প্রতিবাদপত্রটি মহাসচিবের দপ্তরে পেশ করেন।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান
একদল পাকিস্তানি সেনা এই দিন কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধারা মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে তাদের অ্যামবুশ করে। দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়; একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
বরিশালে পাকিস্তানি সেনাদের গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ পেরোনোর সময় ভোলা নদীর দুই তীর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুন্দরবন এলাকায়ও আরেকটি গানবোট খুলনা যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। উভয় ঘটনায় পাকিস্তান সেনারা হতাহত হয়।
সিলেট শহরের কদমতলী ঝালোপাড়ার কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ অ্যামবুশ করে কয়েকজন সেনাকে হতাহত করে। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানায় হামলা করলে পাকিস্তানি রেঞ্জার, পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।
যুক্তরাজ্যের মর্নিং স্টার পত্রিকায় দিল্লি থেকে রয়টার্স পরিবেশিত খবর উদ্ধৃত করে এদিন বলে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে বলেছেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। অতএব পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মধ্যবর্তী স্থল-যোগাযোগ কেটে দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভারতের পূর্বাঞ্চল দখল করা উচিত।
১৮ আগস্ট সকালে হবিগঞ্জের মাকালকান্দি গ্রামে মনসা ও চণ্ডীপূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। এ সময় বানিয়াচং থানা সদর থেকে বেশ কয়েকটি নৌকায় করে এসে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা গ্রামটিতে হামলা চালায়। এতে ৮৮ গ্রামবাসী প্রাণ হারান। এর মধ্যে ৪৪ জনই ছিলেন নারী। এরপর হামলাকারীরা ব্যাপক লুটতরাজ করে গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নওগাঁর কুলফতেপুরে হামলা করে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে শহীদ এবং ১২ জনকে আহত করে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, চার, আট ও নয়; দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ আগস্ট ১৯৭১; মর্নিং স্টার, ১৮ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৯ ও ২০ আগস্ট ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
কালশী মোড়ে পুলিশের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
-
তাঁরা বিদেশে বসে ‘বোতাম টেপেন’, আর ঘটনা ঘটে ঢাকায়
-
ঘুষ নিতে বাড়িতে আসা কনস্টেবলকে আটকে ৯৯৯–এ ফোন, তারপর...
-
বিএনপি নেতা ইশরাক কারাগারে
-
বিরোধীরা ‘এককাট্টা’, এই বার্তা দিতেই বৈঠক বিএনপির