মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
ইয়াহিয়াকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র লন্ডনে ১৭ নভেম্বর জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লন্ডন সফরের পর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ মন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গত মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড একই দিনে দিল্লিতে বলেন, পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তাঁর সরকার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এদিন এক খবরে বলা হয়, ভারত সফররত ব্রিটিশ মন্ত্রী রিচার্ড উড মুম্বাই পৌঁছানোর পর বলেন, পূর্ববঙ্গের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হবে। তাঁর ধারণা, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথের পক্ষে কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব নয়।
ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য হবেন
নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত এবং শেখ মুজিবের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে জানায়, চার সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলখানার আদালতকক্ষে উদাস ও শীর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে।
পত্রিকাটি জানায়, পাকিস্তানের দুই অংশের মধে৵ মীমাংসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বাংলাদেশের নেতারা তাতে বিক্ষুব্ধ। রেহমান সোবহান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম জার্মানি এ দিন দুই হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, বিপুল পরিমাণ শীতবস্ত্র এবং ওষুধ পাঠায়। এসব সাহায্যসামগ্রী কলকাতায় রেডক্রস, ইউনিসেফসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ১৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। ঢাকা শহরে সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করায় প্রমাণিত হচ্ছে যে ঢাকা শহর তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এ দিন ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। তারা ঢাকার সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাতে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বলা হয়, কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শহরকে দুষ্কৃতকারী মুক্ত করতে ১৭ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গী বাজারে ১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের অভিযানে এ দিন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহার চৌধুরী নিহত হন।
১১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে চালানো অভিযানে ঈশ্বরগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুল গণি নিহত হয়।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান পেশোয়ারে বলেন, দেশে যখন আগুন জ্বলছে, তখন কিছু লোক ক্ষমতার কথা বলছেন। তিনি প্রায় চার মাস বিদেশ সফরের পর এ দিন দেশে ফেরেন। দেশের গভীর সংকটে নেতাদের উদাসীনতায় তিনি আক্ষেপ করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত দক্ষিণপন্থী জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিরোধ করার চেষ্টা করায় ওই জোটের শরিক দলগুলোর সমালোচনা করেন। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে পুতুল সরকার গঠন করা হলে বিপ্লব অনিবার্য।
পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র চলছে। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র সফল হলে পশ্চিম পাকিস্তানও কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হবে।
পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাব্বিশা গ্রামে ৩২ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ থেকে যমুনা নদী পার হয়। এরপর দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল ছাব্বিশার পশ্চিম পাশে শালদাইর সেতুর কাছে এবং আরেক দল ছাব্বিশার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নেয়। ছাব্বিশার পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তখন ছাব্বিশা গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়।
সূত্র: ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৮ ও ১৯ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৭ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে