মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

ইরাকে বাঙালি রাষ্ট্রদূতের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনাধারা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ ২১ আগস্ট লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্যের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারেননি। সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। পদে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দিতে তিনি লন্ডনে চলে আসেন।

আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত যেসব বাঙালি কূটনীতিক বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে আবুল ফতেহই ছিলেন সবচেয়ে উচ্চপদস্থ।

আবুল ফতেহ লন্ডনে পৌঁছেই যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। তাঁর এ সিদ্ধান্তের কথা বিচারপতি চৌধুরী তারবার্তা পাঠিয়ে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারকে জানান।

পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আপস নয়

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোনো আপস নেই। বাংলাদেশের মানুষ আজ এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি বৈঠক শুরু হবে বলে গতকাল ডেইলি টেলিগ্রাফে যে সংবাদ বেরিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি এই মন্তব্য করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ সরকার যে তিনটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছে, সেসব শর্ত পূর্ণ না হলে কোনোরকম শান্তি আলোচনার প্রশ্নই উঠতে পারে না। শর্ত তিনটি হলো ১. পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কর্তৃক স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি। ২. অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ৩. বাংলাদেশের মাটি থেকে সকল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অপসারণ। তিনি বলেন, আমরা ফিরতে পারি না। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যায় লাখ লাখ প্রাণ কোরবানি হয়েছে। সে ত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। শহীদদের আমরা ভুলতে পারি না।

কানাডার টরন্টো শহরে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে যোগদানকারী ব্রিটিশ, মার্কিন, ভারতীয় ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ২১ আগস্ট পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের জন্য আহ্বান জানান। কানাডার অক্সফাম এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সাংসদ, বুদ্ধিজীবী, সাবেক কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনেরা এ সম্মেলনে যোগ দেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথও এতে অংশ নেন। ১৯ আগস্ট শুরু হওয়া এ সম্মেলন এদিন শেষ হয়।

সম্মেলনের ঘোষণায় বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ রক্ষার জন্য আবেদন জানিয়ে বলা হয়, তাঁর গোপন বিচার আইনের শাসনবিরোধী। তাঁর প্রাণদণ্ড হলে বাংলাদেশ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক পন্থার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। দেশভাগ ছাড়া আর কোনো পথও নেই।

সম্মেলনের গোপন অধিবেশনে বেশ কয়েকজন আমেরিকান প্রতিনিধি পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলেও সম্মেলনে যোগ দেওয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ আটজন মার্কিন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহতভাবে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা করেন। তাঁরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যা করছে, তা আমেরিকার স্বার্থের বিরোধী এবং বিশ্বের নীতিবোধকে ক্ষুণ্ন করেছে।

ভারত ও পাকিস্তানে

ভারত সফররত পূর্ব জার্মানির সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ড. আর জিবার দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছানুযায়ী ওই দেশের মূল রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর স্থায়ী মীমাংসা করতে পারলেই পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিন সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, কলকাতাসংলগ্ন এলাকা এবং সীমান্ত এলাকায় তাঁরা শরণার্থীদের বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ এদিন নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব মাহমুদুল হক ওসমানিকে গ্রেপ্তার করে ছয় মাসের আটকাদেশ দেয়। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলায় তাঁকে আটক করা হয়।

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এদিন আনসার অধ্যাদেশ ১৯৪৮ বাতিল করে রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১ জারি করে। এর মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর অ্যাডজুট্যান্টদের করা হয় রাজাকার অ্যাডজুট্যান্ট। অরডিন্যান্সের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তান সরকার ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। আরও বলা হয়, প্রাদেশিক সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সব রাজাকার অথবা নির্দিষ্টসংখ্যক রাজাকারকে প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ দিতে পারবে।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

জয়বাংলা পত্রিকার ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট সংখ্যার সাম্প্রতিক যুদ্ধ প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর শ্যামনগর অবস্থানের ওপর তিনটি কলামে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন হুদা, লে. বেগ এবং নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিলদার সোবাহানের নেতৃত্বে তীব্র আক্রমণ চালায়। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এ সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী চারজন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার ও চারজনকে আহত অবস্থায় বন্দী করে। অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ইলিয়াসসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর একটি দল এদিন কুমিল্লার উত্তরে একটি রেলসেতুর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

চুয়াডাঙ্গার উত্তরে আলমডাঙ্গায় এদিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; দৈনিক পাকিস্তান, ২২ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান