মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
আর আলোচনায় নয়, মুক্তি এখন যুদ্ধে
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনাধারা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ
একাত্তরের ৭ জুলাই ছিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের বৈঠকের সমাপনী দিন। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এদিন বলেন, পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোনো প্রস্তাব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার, সব সৈন্য প্রত্যাহার করার এবং যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চারটি শর্ত তাঁরা দিয়েছিলেন। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খান যে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, তাতে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কূলে যুদ্ধের মাধ্যমে।
বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ, ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা বৈঠকে স্থির করেছেন, মুক্তিসেনাদের আক্রমণ আরও জোরদার করা হবে। যতটা সম্ভব বর্ষার আগেই এলাকা থেকে মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। একেক মুক্ত এলাকার দায়িত্ব নেবেন একেক গণপ্রতিনিধি। এলাকায় থেকেই তাঁরা সবকিছু পরিচালনা করবেন।
ফ্রান্সের পাকিস্তান দূতাবাসের দুই বাঙালি কূটনীতিক মোশাররফ হোসেন ও শওকত আলী এদিন ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাতে এক বেতার সাক্ষাৎকারে তাঁরা বলেন, দূতাবাসে তাঁদের দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাঁদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করা হচ্ছিল।
ইন্দিরা-কিসিঞ্জার বৈঠক
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধী কিসিঞ্জারকে বলেন, বাংলাদেশে এমন মীমাংসা দরকার, যাতে শরণার্থীদের এই বিশ্বাস জন্মায় যে ফিরে গেলে সেখানে তাঁদের জীবন ও স্বাধীনতা নিরাপদ। নইলে শরণার্থীরা ফিরে যাবে না। কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিক্সনের একটি চিঠি দেন।
হেনরি কিসিঞ্জার এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও পরিকল্পনামন্ত্রী সুব্রাহ্মনিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশ সংকটের কারণে উদ্ভূত ঘটনা থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ নিয়ে তাঁরা কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারত সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদের তিন সদস্যের সবাই কলকাতায় রাজভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে মন্তব্য করেন, পূর্ব পাকিস্তান নামে আর কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে বলে তাঁদের মনে হয় না। বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। তিন প্রতিনিধিই জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে সিপিআই নেতা ভুপেন গুপ্ত এবং নব কংগ্রেস সদস্য শশিভূষণের নেতৃত্বে ২০ জন সাংসদ দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের সমর্থনে স্লোগান দেন এবং দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি জমা দেন।
পশ্চিম জার্মানি সাহায্য দেবে না
পশ্চিম জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী ড. ব্রাহার্ড এপলার এক বেতার সাক্ষাৎকারে বলেন, সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শর্ত না মানলে তাঁর দেশ পাকিস্তানকে আর উন্নয়ন সাহায্য দেবে না। নানা শর্তের মধ্যে একটি ছিল সব পক্ষের জন্য সন্তোষজনক পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের একটি রাজনৈতিক মীমাংসা।
টাইমস পত্রিকায় বিদেশে প্রচারিত বাংলাদেশে চলমান নৃশংসতার কাহিনি প্রত্যাখ্যান করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলীর একটি দীর্ঘ পত্র প্রকাশিত হয়। বুদ্ধিজীবীদের গণহারে হত্যার সত্যতা অস্বীকার করে তাঁরা বলেন, গত ২৫-২৬ মার্চ ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলের আশপাশের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র নয়জন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। যে ভবনে তাঁরা বাস করতেন, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সশস্ত্র ব্যক্তিরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে ওই ভবনগুলো ব্যবহার না করলে তাঁরা নিহত হতেন না।
পাকিস্তান ডেমেক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এদিন লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধ মোকাবিলায় জনমত সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে জনসভা করার অনুমতি দেওয়া উচিত। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশা করেন।
সূত্র: ইত্তেফাক, ৮ ও ৯ জুলাই ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত ৮ ও ৯ জুলাই ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
Also Read
-
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি: রাজনৈতিক সমঝোতায় সমাধান খুঁজছে সরকার
-
ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় দানা
-
উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না
-
সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে সেটা এই আন্দোলনে থাকা সবার ভুল: আসিফ নজরুল
-
ছেলেদের লিগে মেয়েদের দল: ‘দুঃসাহসী’ রামসবটম ক্রিকেট ক্লাবের গল্প