মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
আর্জেন্টিনায় আনুগত্য বাঙালি রাষ্ট্রদূতের
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানান। বুয়েনস এইরেসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ঘোষণা দিয়ে বলেন, তাঁর আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পদ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র এ দিন জানান, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা এখন মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। মুক্তাঞ্চলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে
মন্ত্রিসভার এক বিশেষ বৈঠকে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার কাছে যুদ্ধের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বর্ণনা দেন।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এ দিন প্রকাশিত এক বুলেটিনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর কামদেবপুরের কাছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০ জন নিহত হয়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা ও কোটচাঁদপুরের মধ্যে রেলের কয়েকটি সেতু ধ্বংস করেন। একই দিন গেরিলারা কামরাইলের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন নিহত হয়। ৬ অক্টোবর দুধগুঁড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ৬ ও ৭ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ফুলবাড়ী, রাজশাহী ও ভূরুঙ্গামারী অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ও টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। এক স্থানে গেরিলারা মাইন দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ উড়িয়ে দিলে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া গেরিলারা ঢাকায় বোমা ছুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থারও কিছু ক্ষতি করেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মজুমদারহাট ও ফেনীর পরশুরামে এই দিন ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত আলাদা দুটি অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
কুমিল্লা সার্কিট হাউস ছিল পাকিস্তানিদের আঞ্চলিক মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার। ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা শহরের ভেতরে অবস্থিত এই সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষণ করলে পাকিস্তানিদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও পুলিশ হতাহতও হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অভিযানের খবর রেডিও পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সংবাদপত্র ভারতীয় আক্রমণ হিসেবে ফলাও করে প্রচার করে।
একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণে রাজগঞ্জেও পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। এই সেক্টরের অন্য আরেকটি দল বাঞ্ছারামপুর থানার দক্ষিণ পশ্চিমে উজানচর-আসাদনগরে অ্যামবুশ রচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টারের সাহায্যে চুয়াডাঙ্গা ও সাঞ্চাডাঙ্গা, চৌগাছা ও মাসলিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। এ ছাড়া খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কূটনৈতিক মহল সাংবাদিকদের জানায়, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি বলেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উক্তি এই মামলাকে প্রভাবিত করছে। ব্রোহীসহ অন্য কৌঁসুলিরা ঢাকায় মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দেন, তা উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। তাঁর এই অপরাধের শাস্তি হবেই। ব্রোহি বলেন, প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য সামরিক আদালতে মামলাকে প্রভাবিত করছে।
রেডিও পাকিস্তান এ দিন জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকেও ৩০ সেপ্টেম্বর একজন প্রতিনিধি মারফত এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের বিবৃতি
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে বর্ণনা করে। বিবৃতিতে তারা এ সম্পর্কে ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই সমস্যার মূল বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করেন। বিবৃতিতে একবার শুধু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে বাকি সব স্থানেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
অপারেশন ওমেগা দলের দুজন সদস্য জেমস স্কারলেট ও স্টিফেন রিভার মুর কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের জন্য পাকিস্তানি প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে তাঁরা জেনেছেন, যাঁরা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কথা জানাচ্ছেন, শুধু তাঁদেরই ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১২ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত ১২ ও ১৩ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে