মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

আন্দোলনরত জনতাকে তাজউদ্দীনের নির্দেশ

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

তাজউদ্দীন আহমদ : জন্ম: ২৩ জুলাই ১৯২৫, মৃত্যু: ৩ নভেম্বর ১৯৭৫

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১১ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ১৪টি নির্দেশ জারি করেন। মূলত সরকারি অফিস, ব্যাংক–বিমা ও অন্যান্য সংস্থা কীভাবে চলবে এবং কী কী বিধিনিষেধ মেনে চলবে—বিবৃতিতে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অন্যান্য দিনের মতো এই দিনও স্টেট ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারিতে স্বাভাবিক লেনদেন চলে। বাংলাদেশের ভেতরে ডাক, তার ও টেলিফোন যোগাযোগ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকে। বিপণিগুলো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খোলা থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় সভা, সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

সংগ্রামী জনতা ঢাকায় সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িকে বাধা দেওয়া হয়। যশোর ও অন্য এলাকাতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া ন্যাপের (ওয়ালি) প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, আওয়ামী লীগের পাঞ্জাব শাখার সভাপতি এম খুরশিদ এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন আলাদাভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।


টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ না করানোর মতো সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ১৬ জন আইনজীবী ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীকে অভিনন্দন জানান।


‘ভিনটেজ হরাইজন’ নামে গমবাহী একটি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ হাজার টন গম নিয়ে আসছিল। সেটিকে গতিপথ বদল করে করাচি বন্দরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৪ নির্দেশনা: পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত গণমানুষের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতিতে ১১ মার্চ নতুন করে ১৪টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে যেকোনো অঙ্কের অর্থ জমা হিসেবে গ্রহণ ও আন্তব্যাংক ক্লিয়ারেন্সসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কাজ করতে পারবে। ধান, পাটবীজ, সার ও কীটনাশক সংগ্রহ, পরিবহন ও বিতরণ অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার এবং চাল গবেষণা কেন্দ্রের কাজ চালু থাকবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজ চলবে। সেনাবাহিনীর চলাচল অথবা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, এমন সামগ্রী খালাসের ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করা যাবে না। ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ইপিআইডিসি) সমস্ত কলকারখানায় কাজ চলবে এবং উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে। ঘূর্ণিঝড়দুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ সব সাহায্য, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজ চলবে। পল্লি অঞ্চলে উন্নয়নকাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও কর্মচারীর মজুরি ও বেতন পাওনা হলে তা পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য হিসাব নিরীক্ষণ অফিসে আংশিক কাজ চলবে। জেলখানার ওয়ার্ডে ও অফিসে কাজ চলবে। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত শাখাগুলো চালু থাকবে।

স্বাধীনতাসংগ্রামে ভাসানীর সমর্থন: টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল ময়দানে এক জনসভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো রকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এখন সাত কোটি বাঙালির নেতা। তিনি বলেন, ‘নেতার নির্দেশ পালন করুন।’
জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের জোর করে কৃত্রিম সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

শেখ মুজিবকে ভুট্টোর তারবার্তা: পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি বলেন, পাকিস্তান এক বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য তাঁদের উভয়েরই অনেক দায়িত্ব রয়েছে।


তারবার্তায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে আরও বলেন, ‘আমি শিগগির আবার ঢাকায় গিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করে উদ্ভূত সমস্যার একটি সমাধান বের করার জন্যও তৈরি আছি। ইতিহাস যেন বলতে না পারে এ কাজে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম।’


গণ ঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান করাচিতে সাংবাদিকদের বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান সকালে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন।

এই দিন করাচি শিল্প ও বণিক সমিতি জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি তারবার্তা পাঠায়। তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন। দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪ নম্বর আদেশ জারি করে বলে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণে বা সেনাবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে তাদের কর্মকাণ্ড আক্রমণাত্মক বলে গণ্য হবে। সামরিক বিধি অনুযায়ী তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও সংবাদ, ১২ মার্চ ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান