মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

আওয়ামী লীগের সভা যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

মুজিবনগরে ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সকাল ১০টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শপথ নিয়ে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিবেদন করা যোদ্ধা ও দেশবাসীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ জন সদস্য তাঁর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বক্তব্য দেন।

সভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি একাধিক প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ২১ অক্টোবর।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাড়াতে সভায় আলোচনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও আলোচনা হয়।

উ থান্টের উদ্বেগ

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানাতে ২০ অক্টোবর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর দেন এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহির সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। পরিস্থিতি যাতে আর খারাপ না হয়, সে জন্য উ থান্ট তাঁদের অনুরোধ জানান।

ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী ও ভাবুক আঁদ্রে মালরো এই দিন বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, এর ফলে তাঁর বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার অধিকার আসবে।

নিউইয়র্ক টাইমস এ দিন তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, বাতাসে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছে। এ প্রসঙ্গে দিল্লির একজন মুখপাত্রের সতর্কবাণীকে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।

সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে গেরিলাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার চলছে। বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর সেনাদের অত্যাচার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ রোধে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর সল্টলেকে শরণার্থী নারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফোঁটা দেন

ভারত ও যুগোস্লাভিয়া ইশতেহারে সতর্কবাণী

যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনা শেষে যুক্ত ইশতেহারে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানের প্রশ্নটি স্থগিত রাখা হলে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই এই সমস্যার একমাত্র মীমাংসা। এর ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র দিল্লিতে এই যুক্ত ইশতেহার প্রচার উপলক্ষে সাংবাদিকদের বলেন, ভারত প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে। বিশ্বসমাজ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে ভারতকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা কত দিনের মধ্যে, তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি।

এই যুক্ত ইশতেহারকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।

ভারতে পূর্ব জার্মানির কনসাল জেনারেল এইচ ফিশার কলকাতায় বলেন, বাংলাদেশের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা করে পাকিস্তানকে এ সমস্যা মেটাতে হবে। এ সমস্যার যথাযথ সমাধানে শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।

কলকাতার সল্টলেকে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সনাতন ধর্মের শরণার্থী নারীরা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফোঁটা দিয়ে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

গেরিলা অভিযান

ঢাকা অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল ২০ অক্টোবর মতিঝিলে স্টেট ব্যাংক ভবনের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) পাঁচতলায় টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে আসবাব ও কাগজপত্রে আগুন ধরে যায়, তবে কেউ হতাহত হয়নি। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ অক্টোবরও মতিঝিলে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানিরা মতিঝিলসহ শহরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। এই জোরালো নিরাপত্তার মধ্যেই গেরিলাদের একের পর এক অভিযানের ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়।

৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে রঘুনাথপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করেন। তারা পাটবোঝাই একটি ট্রাক পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত এবং পাটবোঝাই ট্রাকটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২১ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ২১ ও ২২ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান