মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
অপারেশন ওমেগার অহিংস অভিযান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ১৭ আগস্ট এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। ভারত থেকে একদল বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী এদিন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তাঁরা শামিল হন অপারেশন ওমেগা নামের একটি অহিংস অভিযানে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদার প্রকট অভাব হলেও সামরিক শাসকদের দৌরাত্ম্যে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারছিল না। অপরিসীম জনদুর্ভোগ লাঘব করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে ত্রাণ অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেন লন্ডনের সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী এবং পিস নিউজ পত্রিকার সম্পাদক রজার মোদি। এ অভিযানের নাম তিনি দেন অপারেশন ওমেগা।
এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল দুটো: এক. দুর্দশাগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ; দুই. বাংলাদেশের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ। ১৬ এপ্রিল তিনি অপারেশন ওমেগার জন্য জনবল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে পিস নিউজ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেন। অপারেশন ওমেগা পরিচালনা করার জন্য কলকাতা থেকে তাঁরা গাড়িতে করে আধা টন বিস্কুট, ৫০০ শাড়ি এবং ওষুধপত্র নিয়ে রওনা দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৪৪ দিন পর এই প্রথম এ পথ দিয়ে একটি বিদেশি ত্রাণ সংগঠন পেট্রাপোল হয়ে সড়কপথে বাংলাদেশের বেনাপোলে প্রবেশ করে। বেলা আনুমানিক ১২টা ১০ মিনিটে অপারেশন ওমেগা দলের আটজন সদস্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের হরিদাসপুরে রেডক্রসের চিহ্ন লাগানো দুটি ল্যান্ড রোভার গাড়িতে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ সময় গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের সদস্যসহ বহু মানুষ সীমান্তে উপস্থিত থেকে তাঁদের অভিনন্দন জানায়।
যশোর রোড দিয়ে মাইক হাতে নিয়ে দলনেতা রজার মোদি তাঁদের প্রবেশের কথা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থামিয়ে হেঁটে এগোনোর নির্দেশ দেয়। তাঁরা ১০০ গজ এগিয়ে গাড়ি থামান। চারজন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র হাতে এসে তাঁদের সঙ্গে তর্ক শুরু করে। একপর্যায়ে ওমেগার সদস্যরা ভারত সীমান্ত থেকে ৫০০ গজ দূরে গাড়িতে থাকা ত্রিপল বের করে সড়কে বিছিয়ে বসে পড়েন। বেলা দেড়টা নাগাদ ওমেগা দলের দুজন নারী সদস্য ক্রিস্টিনা প্রাট, তোরেন প্লামনিংসহ দুজন পুরুষ সদস্যকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বিকেল পাঁচটা নাগাদ দুজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা এসে গাড়ি দুটি তল্লাশি করে।
জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন
আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের একজন মুখপাত্র এদিন নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে মানবিক অধিকার ভঙ্গের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন কমিশন। সংখ্যালঘু রক্ষা এবং বৈষম্য প্রতিরোধসংক্রান্ত উপকমিশনের কাছে জন সালজবার্গ আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে এ প্রস্তাব দেন। আন্তর্জাতিক আইন কমিশন এ দিন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রতিবাদ এবং বিচার বন্ধ করার জন্যও পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন জানায়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর করাচির সংবাদদাতার ভাষ্য উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, সামরিক আদালতে একজন ব্রিগেডিয়ারের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবের বিচার চলছে। লায়ালপুরের কাছে এই সামরিক আদালত বসেছে বলে সবার ধারণা। আরেকটি খবরে বলা হয়, একজন কৌঁসুলি নিয়োগের ব্যাপার নিয়ে শেখ মুজিবের বিচার মুলতবি রয়েছে। তাঁর পক্ষ সমর্থনের জন্য এখনো কোনো কৌঁসুলি নেই। একটি বেসরকারি সূত্রের খবরে কৌঁসুলি হিসেবে পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী এ কে ব্রোহির নাম উল্লেখ করা হয়।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য পাকিস্তান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি সদিচ্ছা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে এক চিঠিতে এ প্রস্তাব দেন।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি আকস্মিক সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রদূত এ এ রদিনভ ইয়াহিয়া খানকে তাঁর সরকারের একটি বার্তা দেন। বার্তায় এ অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্স কোসিগিন ইয়াহিয়া খানকে সে চিঠিতে বলেন, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের জন্য হবে আত্মহত্যার শামিল। পাকিস্তানকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে যেন তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি না দেয়। এ ছাড়া চিঠিতে পূর্ব বাংলায় উৎপীড়ন বন্ধ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারে আর না এগোতে বলা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর এবং ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আরও ১৬ জন সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এঁরা হলেন আতাউর রহমান তালুকদার, ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ, খালিদ আলী মিয়া, শাহ মোহাম্মদ জাফরউল্লাহ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আমির-উল ইসলাম, আজিজুর রহমান আক্কাস, আবু আহমদ আফজালুর রশিদ বাদল, শহীদ উদ্দিন, খন্দকার আবদুল হাফিজ, সোহরাব হোসেন, এম রওশন আলী, সুবোধ কুমার মিত্র এবং মোহাম্মদ মহসীন। নির্দেশে বলা হয়, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হাজির না হলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে।
সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৮ ও ১৯ আগস্ট ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ছে, তালিকায় থাকতে পারে ৩০টির বেশি দেশ
-
খালেদা জিয়ার জন্য জার্মানির প্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়া করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে কাতার
-
চোখের সামনে সঙ্গীদের মেরে আমাদের ভয় দেখাত
-
জাতীয় চিড়িয়াখানার খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেল সিংহী, দুই ঘণ্টা পরে নিয়ন্ত্রণে
-
প্রথম আলো আজ শুধু পত্রিকা নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান